কারুর মৃত্যুর পর সাধারণত আমি কিছু লিখিনা। লিখতে পারি না। কিন্তু আজ যেটা লিখছি সেটা শোকের কথা নয়, আমার ভালোলাগা সময়ের কথা, একটা স্মৃতিচারণ।
সালটা ২০০৩, তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমার পাশের বাড়িতে একটা ছোটো কারখানা গড়ে উঠেছে বছর দুয়েক হল, যেখানে বিভিন্ন ইলেকট্রিকাল কাজকর্ম হত। হরেক রকম যন্ত্রপাতির মেলা, কত লোকের আসা যাওয়া – আমাকে টানত বারবার। আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভিতরের কাজকর্ম দেখতাম। বিভিন্ন ধরনের মোটর, কয়েল, ট্রান্সফর্মার, বিভিন্ন মেটাল ডাইস, আরো কত কী তৈরির কাজ চলত। ‘চ্যাটার্জি বাবু’ নামক এক ব্যক্তি আজব আজব সব জিনিসপত্র নিয়ে আসতেন রিপেয়ারিং-এর জন্য। আমি তাজ্জব হয়ে কারখানার মালিক দুলাল কাকাকে দেখতাম – এমন কি কোনো জিনিস আছে যা এই লোকটা সারাই করতে পারে না?!
কারখানার প্রতি আমার টানটা বাড়তে শুরু করেছে ততদিনে। সকালে টিফিন করেই পৌঁছে যেতাম কারখানার দরজায়। আবার আসতাম দুপুরের স্নান-খাওয়া সারতে। তারপর আবার চলে যেতাম। সন্ধ্যায় পড়তে যাবার আগে পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতাম। কাজ দেখতাম ওদের।
তারপর একদিন সকালে যেতেই যেই দাদাটা লেদ মেশিন চালাত, সেই মনুদা আমাকে ভিতরে বসতে বলল, জায়গা করে দিল বসার। সেই থেকে ওই কারখানাই হয়ে উঠল আমার দ্বিতীয় বাড়ি। মনুদা, বিশ্বনাথদা, পিন্টু কাকা, দুলাল কাকাদের নিয়ে জমে উঠল আমার কৈশোরের একটা অধ্যায়।
মনুদা এই কারখানার কাজ ছেড়ে অন্য কারখানায় চাকরি নিয়ে চলে যাবার আগে এনে দিয়ে যায় আরেকজন লেদ মিস্ত্রিকে, বিভাসদাকে। এই বিভাসদার সাথেই পরবর্তীকালে আমার বন্ধুত্ব সবথেকে বেশি গাঢ় হয়, আর এই বিভাসদাই কারখানার এক কোণে রাখা ফিলিপ্স-এর রেডিওতে প্রথমবারের মত আমায় শোনায় কেকে-র গান। গান চালিয়ে বিভাসদা লেদ মেশিনে নিজের কাজে ব্যস্ত হবার পর আমার মুখ থেকে স্বগতোক্তি বেরিয়ে এসেছিল – “কি গলা! পুরো ম্যাজিকাল ভয়েস!”
প্রথম প্রথম কারখানার কোনো জিনিসে হাত দিতাম না, কেউ না বললে। কিছুদিন কাটার পর সাহস বাড়ল। রেডিওটা চলে এল আমার দখলে। তখন থেকে শুধুই কেকে আর জুবিন গর্গ। জুবিনের খুব বেশি গান ছিল না, অতএব কেকে-র একটা গান শেষ হতেই চ্যানেল ঘুরতে ঘুরতে যেই ফ্রিকোয়েন্সিতে কেকে-র আরেকটা গান চলত সেখানে এসে থামত আঙুল।
পড়াশোনা যখন না থাকত তখন রাত পর্যন্ত থেকে যেতাম কারখানায়। সন্ধ্যায় মুড়ি, চানাচুর, লঙ্কা, পেঁয়াজ ও চপ দিয়ে চলত টিফিন। সাথে কেকে-র গান। মাঝে মাঝে আমি আর বিভাসদার একসাথে রেডিওর সুরে গলা মিলিয়ে চলত গান।
নামমাত্র পড়াশোনা, ক্রিকেট, কারখানায় কাজ শেখা, আর কেকে-র গান জীবনের প্রতিটি আবেগে-ভালোবাসায় – এই ছিল আমার কৈশোর কাল। এরপর একদিন বড় হয়ে গেলাম। অনেক বড় হয়ে গেলাম! ২০০৯ সালে বাড়িতে আমার প্রথম কম্পিউটার এল। সেখানেও কেকে-র গান লুপে চলত।
এখনও কোনো জায়গায় কেকে-র গান চলতে থাকলে, ফেরার তাড়া থাকলেও আমি সেই জায়গায় আরো কিছুটা সময় থাকি গানটা শেষ হওয়া পর্যন্ত। ভালোবাসার গায়কের সাথে শ্রোতার বোধহয় এটাই সম্পর্ক!
আমার কৈশোর কালের আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই এখন। যা টিকে আছে তাও পলকা সুতোয় বাঁধা কিছু সম্পর্ক। কেকে-ও চলে গেলেন কাল। যা চিরন্তন থেকে গেল তা শুধু কষ্ট।