উপন্যাস – গ্লানির্ভবতি ভারত, লেখক – দেবারতি মুখোপাধ্যায়, প্রকাশক – দীপ প্রকাশন
(বিঃদ্রঃ যারা এই সিরিজের বাকি বইগুলো সম্পর্কে আমার মতামত পড়েননি, তারা এখানে ক্লিক করে দেখতে পারেন।)
হুগলি জেলার বিভিন্ন এলাকায় খুন হয়ে যাচ্ছে ছোটো থেকে বড় নানান ব্যবসায়ী। উপর থেকে দেখে বোঝা যায় – কোনো একটাই চক্রের কাজ এটা। কিন্তু ক্ষুদ্রতম একটা সূত্রেরও নাগাল মিলছে না। এমন অবস্থায় তদন্তের দায়িত্ব গিয়ে পড়ে সদ্য পুলিশে জয়েন করা অফিসার রুদ্রাণীর উপর। রুদ্রাণী এর আগে কয়েকবার কিছু রহস্যের সমাধান করলেও আইনসিদ্ধ ভাবে এটাই তার প্রথম কাজ। সুতরাং, অনভিজ্ঞ রুদ্রাণী তার দল নিয়ে কিভাবে এই রহস্যের জট খুলবে – তা নিয়েই এই গল্প।
গল্পে লেখিকা আমেরিকার ‘আমিশ’ সম্প্রদায়ের অনুরূপ বাংলাতেও একটি ‘আমিশ’ সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে – ‘আমিশ’ সম্প্রদায় আবার কী? এক কথায় বলতে গেলে – যাঁরা আধুনিকতাকে বর্জন করে, দেশের বাকি সাধারণ মানুষের মত কোনোরকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ না করে, গোষ্ঠীবদ্ধভাবে প্রাচীন কালের মানুষদের মতই জীবন অতিবাহিত করে চলেছেন – তাঁরাই ‘আমিশ’। এই সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে আরেকটু বিশদে জানতে হলে বইটি পড়তে হবে, লেখিকা খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা দিয়েছেন এই সম্প্রদায়ের। এছাড়াও এই বইতে আমরা একটি বিশেষ ভূমিকায় পাই অষ্টাদশ শতকের বিখ্যাত বাঙালি পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন-কে। তাঁর পান্ডিত্য এবং তৎকালীন ভারতীয় সমাজে তার অবদানের বহু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে এই বইতে। প্লট খুবই ভালো। গল্পের সাথে ইতিহাসকে জোড়া হয়েছে খুব সুন্দর এবং সুপরিকল্পিতভাবে। বেশ কিছু জায়গায় আমি এই সিরিজের দ্বিতীয় বই (আমার খুবই পছন্দের) ‘নরক সংকেত’-এর আদল লক্ষ্য করলাম। লেখিকা বরাবরই কিছু লেখার আগে অত্যন্ত ভালোভাবে গবেষণা করেন, সেজন্য তাঁকে বরাবরের জন্য কুর্নিশ। তবে তাঁর লেখনীর তথ্য পাঠককূলের কাছে পৌঁছে দেবার ব্যাপারে তাঁর আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তিনি এক জায়গায় লিখছেন “মৃন্ময়ী মানেও তো মা দুর্গা” (পৃষ্ঠা ২০৬)। আসলে মাটির তৈরি যেকোনো জিনিসকেই ‘মৃন্ময়ী’ বলা হয়। এরকম কিছু কথা পড়ার সময় চোখে লাগে খুব। যা আমি ‘নরক সংকেত’-এ উল্লিখিত ‘মারিজুয়ানা’-র ক্ষেত্রেও বলেছিলাম। একটি জায়গায় রুদ্র তার তদন্তের উপলব্ধি থেকে একটি থিওরি তৈরি করে – আততায়ী খুনগুলো শুধুমাত্র কৃষ্ণপক্ষে করছে, সুতরাং সে অপেক্ষা করে পরবর্তী কৃষ্ণপক্ষ আসার। কৃষ্ণপক্ষ মাসের পনেরো দিন জুড়ে থাকে। নির্দিষ্ট এক বা দুদিন নয়। সুতরাং উক্ত পনেরো দিনের মধ্যে খুনী ধরার পরিকল্পনা অনেকটা মাঝ সমুদ্রে খোলা হতে মাছ ধরার মত। একজন IPS অফিসারের এরকম ভাবনা আমার কাছে অনেকটা বালখিল্য ধরণের মনে হল। লেখিকা গল্পে বর্ণিত সমস্ত ঘটনার সাথেই পৌরাণিক চরিত্র ‘কৃষ্ণ’র সম্পর্ক জুড়েছেন। আমার মনে হয় শুধুমাত্র কৃষ্ণপক্ষে খুন করার ব্যাপারটা সেখান থেকেই এসেছে (আমার ধারণা ভুলও হতে পারে)। ‘কৃষ্ণপক্ষ’ নামটির সাথে পৌরাণিক চরিত্রটির নামের মিল থাকলেও এঁদের মধ্যে আর কোনো সম্পর্ক নেই। কৃষ্ণ অর্থ – কালো, শুক্ল অর্থ – সাদা। সুতরাং, আমার মনে হয় ‘শুধুমাত্র কৃষ্ণপক্ষে খুন’ করার ব্যাপারটা যদি তুলে দিতেন, তাহলে একটা অতিরিক্ত জট পাঠককে বিভ্রান্ত করত না। গল্পের শেষের দিকে লেখিকা দুর্দান্ত একটা টুইস্ট দিয়েছেন, এবং রুদ্রাণীর সরকারিভাবে প্রথম কাজ ও তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সুন্দর একটা প্লট বুনেছেন – যেটা আমার খুব পছন্দের একটা অংশ। তবে, যেই ব্যক্তি আধুনিকতাকে ঘৃণা করেন, সেই আবার তার সম্প্রদায়ের অলক্ষ্যে আধুনিকতার অংশ হয়ে রয়েছেন – এটা আমার কাছে একটু গুরুপাচ্য মনে হল। যদিও লেখিকা এর সাপেক্ষে একটা যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করেছেন, তবুও…